- স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবী সরোজ কুমার বসু
রায়গঞ্জ শহরের গর্ব বিপ্লবী সরোজ কুমার বসু ১৯১৫ সালের ১ লা মার্চ বর্তমান বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলায় জন্ম গ্রহণ করেন । পিতা স্বর্গীয় আনন্দ মোহন বসু ছিলেন আইনজীবী , মা স্বর্গীয় কাদম্বিনী বসু এর ছিল উজ্জ্বল সাংস্কৃতিক পরিবার । তাঁর যখন ৪ বছর বয়স , মাত্র ৬ মাসের ব্যবধানে পিতৃ ও মাতৃ বিয়োগ হওয়ায় রায়গঞ্জের “বড়বাসায়” দাদুর বাড়িতে তাঁর বেড়ে ওঠা । রায়গঞ্জের গোপাল বন্ধু পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ , রায়গঞ্জ করোনেশন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এর পাঠ গ্রহণ করেন , মাধ্যমিক এ প্রথম ডিভিশনে ১৯৩১ সালে উত্তীর্ণ হন । তিনি যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়াশুনা করেন তখন থেকেই তাঁর সঙ্গে বাংলার বিপ্লবী সংগঠন “অনুশীলন সমিতি” র সক্রিয় যোগাযোগ হয় ।
....
তিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে যুক্ত হন স্বর্গীয় বিভূতি গুহ , অনুশিলন সমিতির অন্যতম সদস্য এবং স্বর্গীয় বরোদা কান্ত চক্রবর্তী , আইনজীবী [ যাহারা ছিলেন গোপন ফ্রন্টের সদস্য ] তাঁদের অনুপ্রেরণায় তিনি সমিতির একজন কর্মী হয়ে ওঠেন । তাঁকে বহরমপুরে পাঠানো হয় “মহারাজা কৃষ্ণ নাথ কলেজে” ভর্তি হওয়ার জন্য কিন্তু তিনি দিনাজপুরের সমিতির কাজ কর্মের দায়বদ্ধতায় , তিনি বৃটিশ রাজের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের কাজকর্মে যুক্ত হয়ে পড়েন ।
“অনুশীলন সমিতি” নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে তাঁরা তাঁদের কার্যকলাপ চালাতেন জাতীয় কংগ্রেসের নামে। সমিতির কাজকর্ম গোপন ভাবে তাঁরা সম্পন্ন করতেন তাঁদের নিরাপত্তা ও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার জন্য । সরোজ কুমার বসু ছিলেন অনুশীলন সমিতির দিনাজপুরের “ইন চার্চ”।
তাঁকে “হিলি মেল রেইড” কেস [ ২৮ শে অক্টোবর , ১৯৩৩ সালে ভোর ৩ টায় সংগঠিত হয় ] এ যুক্ত থাকবার অপরাধে আন্দামান জেলে পাঠানো হয় । ১২ জন সহযোদ্ধা এই কেস এর মুল অভিযুক্ত ছিলেন ।
KING EMPEROR
Versus
1. Pran Krishna Chakraborty [ Accused ]
2. Hrishikesh Bhattercharjee [ Accused ]
3. Satyabrata Chalraborty [ Accused ]
4. Saroj Kumar Bose [ Accused ]
Prafulla Narayan Sanyal & 5 other Co – accused
1. Ashok Ranjan Ghosh [ Approvers ]
2. Sashadhar Sarkar [Approvers ]
3. Lalu Pande [Approvers ]
Inter Provincial conspiracy case চালানোর জন্য এবং অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ ও সংগঠনের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয় । ঐ সময় হিলি ব্যাবসায়িক প্রাণ কেন্দ্র থাকায় এবং প্রচুর রাইস মিল থাকায় উক্ত ব্যবসার টাকা , ট্রেজারীর টাকা এবং পোস্টাল বিভাগের টাকা হিলি স্টেশনে রেল এর মাধ্যমে আদান প্রদান হত। সে কারনে অনুশীলন সমিতির সেন্ট্রাল কমিটিতে হিলি স্টেশনে টাকা লুঠ এর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় । সেই কারনে অনুশীলন সমিতির তৎকালীন অখন্ড উত্তর বঙ্গের ভারপ্রাপ্ত নেতা প্রাণকৃষ্ণ চক্রবর্তী ,ঋষিকেশ ভট্টাচার্য্য , সত্যব্রত চক্রবর্তী , সরোজ কুমার বসু ও অনান্য সদস্যরা গোপন বৈঠকে “হিলি স্টেশন রেইড” করে সমিতির জন্য অর্থ লুন্ঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ।
২৬ শে অক্টোবর , ১৯৩৩ বিপ্লবীরা জড়ো হন আব্দুল কাদের চৌধুরীর বাড়িতে যিনি ঐ অঞ্চলের ডাক্তার ছিলেন । সেখানে বসেই তাঁরা পুরো ঘটনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন । এই সমস্ত ঘটনা বিল্পবী সরোজ বোস তাঁর স্মৃতি থেকে বলে গেছেন যখন তাঁর বয়স ৮৫ বছর । এর সত্যতা আমরা পাই সরোজ বাবুর সমসাময়িক সময়ের বিভিন্ন কাগজ এবং বই এর লেখা থেকে যা এই ইতিহাসে সাক্ষী ।
বিপ্লবীদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৭ শে অক্টোবর , ১৯৩৩ সালে অপারেশন সংগঠিত করবার কথা ছিল কিন্তু পুলিশ এবং সন্দেহভাজন কিছু ব্যাক্তির কার্যকলাপে তাঁদের পরিকল্পনা এক দিন পিছিয়ে দেওয়া হয়। ২৮ শে অক্টোবর , ১৯৩৩ সালে ভোর ৩ টায় বিপ্লবীরা মেইল ব্যাগ লুঠ করা শুরু করে । তাঁরা যখন অপারেশন করছিলেন তখন হঠাৎ করে চিৎকার শুরু হয়, পোষ্ট অফিসের পিওন যারা বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তাঁরা দৌড়াদৌড়ি শুরু করেন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য । বিপ্লবীরা স্টেশনের লোকজনকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য বন্দুকের নল প্যাটফর্মের দিকে গুলি [ ছড়রা দিয়ে ] করে যাহাতে লোকজনের প্রাণসংশয় না ঘটে । সত্যব্রত চক্রবর্তী ও সরোজ কুমার বসুর কাছে দুটি বন্দুক এবং প্রাণকৃষ্ণ চক্রবর্তীর ও ঋষিকেশ ভট্টাচার্য্যের কাছে পিস্তল ও রিভালভার ছিল । ষ্টেশন মাষ্টার বাইরে বেড়িয়ে এসে স্বদেশী দের উদ্দেশ্যে তার বন্দুক থেকে গুলি ছোড়েন ফলত বিপ্লবী কালি চরণ মাহালীর শরীরে গুলি লাগে গুরুতর ভাবে জখম হন পরবর্তীতে তাঁকে কলকাতায় স্থানান্তরিত করা হয় ২৯ শে অক্টোবর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ।
কার্য সম্পাদনের পরে তাঁরা তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে তিন দিকে চলে যান । মুল দলে নেতৃত্ব সহ অনান্য কয়েক জন সামঝিয়ার দিকে যান । ইতিমধ্যে বৃটিশ গোয়েন্দা বিভাগ চর মারফত চতুর্দিকে ঘটনা জানিয়ে দেন । এবং বিপ্লবীদের ধরবার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে ।বৃটিশ পৃষ্ঠপোষক জমিদার কৃষ্ণ চন্দ্র রায় তার লোকজন নিয়ে আত্রেই নদীর পারে সামঝিয়া ঘাটে প্রস্তুত থাকেন । বিপ্লবীদের মুল অংশ সমঝিয়া ঘাটে পৌছলে জমিদারের লেঠেল বাহিনী “ডাকাত” বলে গ্রামবাসীদের প্ররোচিত করে এবং গ্রামবাসীরা সকলে বিপ্লবীদের ঘরে ফেলে , নিরীহ গ্রামবাসীদের জীবন সংশয় হবে মাথায় রেখে বিপ্লবীরা তাঁদের অস্ত্র ব্যবহার করেন না এবং নিজেদের প্রাণরক্ষার্থে নদীতে ঝাঁপ দেন । জমিদারের লেঠেল বাহিনী বিপ্লবীদের ধরে ফেলে থানায় দিয়ে দেন ।
২৭ শে নভেম্বর , ১৯৩৩ সরকার গেজেটের মাধ্যমে [ 13258 P ] এর মাধ্যমে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করে MR. E.S.Simpson , ICS , জেলা দায়রা আদালত , রাজশাহী , বিপিন বিহারী মুখার্জী , অবসর প্রাপ্ত বিচারপতি জেলা দায়রা আদালত এবং মৈলবী এমবাদ আলি , সাব ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট কে কমিশনার হিসেবে নিযুক্ত করা হয় , MR. E.S.Simpson , ICS কে এই ট্রাইব্যুনাল এর সভাপতি করা হয় । ০২.১২.১৯৩৩ থেকে সাক্ষী পর্ব শুরু হয় । মোট ১৯৮ জন সাক্ষী দেন । ২৭.০২.১৯৩৪ সালে প্রাণকৃষ্ণ, ঋষিকেশ , সত্যব্রত , সরোজ কুমার বসু [ নাবালক থাকা স্বত্বেও ] অপারেশনের গুরুত্ব বুঝে তাঁদের সর্বোচ্চ সাজা ফাঁসির আদেশ প্রদান করা হয়।
এবং অনান্য আসামীদের নিন্মরূপসাজা ঘোষণা করা হয় -
Kalipada Sarkar 10 years rigorous imprisonment
Ramkrishna Sarkar 10 years rigorous imprisonment
Haripada Bose 10 years rigorous imprisonment
Prafulla Narayan Sanyal Transportation for Life
Abdul Kader Choudhury Transportation for Life
Kiran Chandra De Transportation for Life
কলকাতা হাই কোর্টে আপিলের ভত্তিতে একটি স্পেশাল বেঞ্চ গঠন করা হয় , বিচারপতি মনমোথ রায় , বিচারপতি পিটারসন , বিচারপতি সুরেন্দ্র নাথ গুহ মামলার শুনানি শোনেন এবং তাঁহারা সিদ্ধান্ত নেন যে – কালীচরণ মাহালীর মৃত্যু বিপ্লবীদের দ্বারা ইচ্ছাকৃত নয় সেকারনে স্পেশাল বেঞ্চ তাঁদের ফাঁসির আদেশ মুকুব করেন । প্রাণকৃষ্ণ চক্রবর্তী ও ঋষিকেশ ভট্টাচার্য্য এর ২৫ বছর জেল হয় , সরোজ কুমার বসু ও সত্যব্রত চ্যাটার্জীর ১০ বছরের সাজা হয় । স্পেশাল বেঞ্চ কালিপদ সরকার কে মুক্তি দেয় বাকিদের সাজা বহাল থাকে । এর পর PRIVY COUNCIL এ স্পেশাল লিভ পিটিশন দাখিল করা হয় । কিন্তু হেয়ারিং এর পর সেই আপিল বাতিল হয়ে যায় এবং তাঁদের আন্দামান সেলুলয় জেলে পাঠানো হয় ।
আন্দামান জেলে অত্যাচারের প্রতিবাদে তাঁহারা ১৯৩৭ সালে ৩৭ দিন এবং ১৯৩৯ সালে ৩৬ দিন অনশন করেন । দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় আন্দমানে নির্বাসিত সকল রাজনৈতিক বন্দিদের মুল ভুখন্ডে নিয়ে আসা হয় এবং এখানে তাঁদের বিভিন্ন জেলে বন্দি করে রাখা হয় । ১৯৪২ সালে সরোজ কুমার বসুকে মুক্তি দেওয়া হলেও জেল গেটেই তাঁকে পুনরায় গ্রেপ্তার করা হয়। অবশেষ ১৯৪৭ সালে অক্টোবর মাসে তিনি বন্দি জীবন থেকে মুক্তি লাভ করেন।
তাঁর কারাজীবন –
দিনাজপুর জেল – বগুরা সেন্ট্রাল জেল – বহরমপুর সেন্ট্রাল জেল- দমদম সেন্ট্রাল জেল – আলিপুর সেন্ট্রাল জেল – প্রেসিডেন্সি সেন্ট্রাল জেল – আন্দামান সেলুলয় জেল । কারা মেয়াদ – ১৩ বছর ।
মুক্তি পাবার পরে তিনি রেলওয়ে ওয়ার্কাস অ্যাসোসিয়েশন এর কাজে যুক্ত হন এবং পরবর্তী কালে কমিউনিস্ট পার্টি বিভাজনের পরে তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেন । এবং প্রাথমিক শিক্ষকতায় যুক্ত হন । রায়গঞ্জ শহরের উকিলপাড়ায় নিজ বসত গৃহে গত ২৭-০৫-২০০৫ সালে ৯০ বছর বয়সে তিনি পরলোক গমন করেন ।